Header Ads

Header ADS

গোপাল ভাঁড়ের গল্পলোকে

নদীয়ার রাজধানী কৃষ্ণনগর। সেখানে রাজত্ব করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। বিশাল প্রাসাদ তার, চৌদিকে বেষ্টিত ইষ্টকনির্মিত দেয়াল। চৌকোনা আকৃতির দ্বিতল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে কত কী আছে! বাগান আছে, বাগানে বানর আছে, পাখি আছে। কত ফলের গাছ থেকে বাহারি সব ফল বাগানের ঘাসের গালিচায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আছে সরোবর সুন্দর। তাতে শতদলের সাথে খেলা করে মরাল। আর তার ধারে আছে শ্বেতপাথরের আসন। প্রতি সকালে মহারাজ বাগানে পায়চারি করেন প্রাতভ্রমণের উদ্দেশে। ব্রাহ্মমুহূর্তের বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে করতে মহারাজ বাগানের সদ্যোত্থিত পাখিসবের কলকাকলি শ্রবণ করিয়া সাধুসাধু রব তোলেন। আর গোধূলিপূর্বে বৈকালিক অবসরে সরোবরের ধারে বসিয়া স্নিগ্ধ সূর্যাস্তের শেষ আলোটুকু গায়ে মাখেন। বড়ই সুন্দর দেশের প্রজাবৎসল নৃপতির এই ছোট্ট রাজপাটটুকু নিতান্তই সাদাসিধে, তথাপি মনোহারিণী।

Gopal
গোপাল ভাঁড়। ছবি সৌজন্য সনি আট
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দৈর্ঘ্যে কিঞ্চিৎ খাটো হলেও চেহারাখানা দশাসই বললে ভুল হবে না। পাকানো গোঁফ তার দু'সীমান্তে তরোয়ালের মতো মসৃণ বাঁক নিয়েছে। শরীরটাতেও মেদের বালাই নেই। মাথায় পাগড়ি, বুকে রত্নহার, পদযুগল আচ্ছাদিত জোড়া নাগরা, নীল পট্টবস্ত্র, আর উত্তরীয়তে মহারাজকে মানায় বেশ। নিত্য সকালে রাণীর তদারকিতে জলখাবার খেয়ে গটগট করে হেঁটে রাজসভায় প্রবেশ করেন রাজামশাই। তার রাজসভায় অষ্টবজ্রের সম্মেলন, নবরত্নের দ্যুতিতে তা সবসময় চকচক করে। তবে কাজের কাজ কী হয় তা নিয়ে আমাদের নিতান্তই কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা বরং রাজসভার সভ্যদের খবর নিইগে।

রাজসিংহাসনের পাশেই বসেন মহামন্ত্রী। মানে সেখানে একটা আসন মন্ত্রীর জন্য পাতা আছে বৈকি, তবে সে আসনে বসে খুব একটা যুত পান না তীক্ষ্ণনাসা মন্ত্রীবর। তার নজর যে মহারাজের সিংহাসনে। সেখানে পাকাপাকিভাবে বসার চিন্তায় তার দিন যায়, রাত যায়, মাস-বছর সবই যায়, কিন্তু সুযোগটা ঠিক আসে না। তবে মন্ত্রী হিসেবে তিনি পুরোদস্তুর পটু, কোনো কাজেই চুরিতে তার নেই জুড়ি। সে কথা পরে হবে, আগে দেখি রাজসভায় আর কে কোথায় বসেন। মহারাজের আসনের পেছনে চামর হস্তে নিরন্তর ব্যজনরত এক ভৃত্য, গোপালের তূণ হইতে নির্গত কৌতুকরস মাখানো তীক্ষ্ণধার বাণটিতেও তার ভ্রুক্ষেপ হয় না। রাজসভায় মহারাজের ডানপাশে বসেন সর্ব গুণে গুণান্বিত হাসির রাজা, রসের রাজা, জ্ঞানের রাজা গুরুভুঁড়ি শ্রীযুক্ত গোপাল ভাঁড় মহাশয়। তার পাশে বসেন শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত মহাবিজ্ঞানী শ্রী ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু থুড়ি উনার নাম জানা নেই। এরপর সৌম্যকান্তি, স্থিতধী বৃদ্ধ রাজবৈদ্য। রাজবৈদ্য মহাশয়ের পরের আসনে অধিষ্ঠান করেন ঝোলাপুরুত রাজপণ্ডিত। বামপাশে কাজের বেলায় লবডঙ্কা অমর্ত্য, তার পাশে বৃকোদরকান্তি, সিক্সপ্যাককে বশ করা সেনাভীতুপতি, আর ঠিক তার পাশেই বসেন কাজকর্মহীন রাজজ্যোতিষী। এ হলো আমাদের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা।

কৃষ্ণনগর রাজ্যখানা ছবির মতো সুন্দর, মনে হয় শিল্পীর সুনিপুণ হাতে পটে আঁকা সযতন ছবি। রাস্তাঘাট মাখনের ন্যায় মসৃণ, একটু বেলেমাটির আভা রয়েছে যেন। নধরকান্তি শ্যামল ঘাসের দল যত্রতত্র জন্মে আছে। পথিকের ক্লান্তি দূর করবে বলে পথেরধারে সুমিষ্ট জল বুকে নিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে বৃহৎ শান্ত পুষ্করিণী। এ রাজ্যের মাঠ, জমিগুলোও মায়ার চাদরে আচ্ছাদিত। তবে তেপান্তরের মাঠের দৌলতে গাছ যেন একটু কম। রাস্তার ধারে, মাঠের মাঝখানে, কারও বাড়ির সামনে কেবল দুএকটা গাছ একসাথে জড়াজড়ি করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য রাজ্যের ধারে বিশাল বিশাল জঙ্গল, সেসব জঙ্গলের সৌন্দর্যবর্ণন আমার কম্মো নয়। এমন জঙ্গল মানুষ আর কখনো দেখবেও না কখনো।

আমাদের গোপালের বাড়িখানায় যেতে হলে নদীর দিকে যে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে, সেটা ধরে এগিয়ে যেতে হবে। তারপর দেখবেন মাটির পাঁচিল, আর খড়ের চালের সমন্বয়ে তৈরি সেই পর্ণকুটির। ঘরখানা আহামরি বড় কিছু নয়। একখানা তক্তপোশ, কয়েকটা কুলুঙ্গি; তার একটাতে জিনিসপাতি, তৈজসপত্র রাখে গোপালের বউ। আরেকটাতে অবস্থান নিয়ে গোপালে স্বর্গগত পিতৃদেবের মূর্তি সারাক্ষণ এই দম্পতি'র ওপর আশির্বাদের কটাক্ষ করে যাচ্ছেন। বিছানার দেয়ালের পাশটাতে আংটায় আটকানো গোপালের তৈলচিটচিটে জামাকাপড়। ঘরের একপাশে একখানা সিন্দুক। এই নির্বিত্ত দম্পতির যা-কিছু বিত্ত তা ওখানটাতেই যতনভরে রাখা আছে। আর আছে পূজো দেওয়ার স্থান, গৃহকর্মে নিপুণা গোপালের আটপৌরে বউটি সেই সিংহাসনে পূজো দেওয়ার আগে প্রতিদিন বাইরের তুলসীতলায় বাতি জ্বালিয়ে রেখে যায়।

গোপালের ঘরের খড়ের চালের দশা করুণ। মহারাজের কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে এই আকালের বাজারে নিজেদের পেট সামলানোই দায়। তার ওপর প্রতি বছরই নতুন করে চাল ছাওয়ানোর দরকার পড়ে। সেই চালের ওপর চালকুমড়োর মাচা পেঁচিয়ে আছে। নাদুস-নুদুস, কচি কচি চালকুমড়ো ঘরের চালের আশ্রয়ে রান্নাঘরের কড়াইয়ে উৎসর্গীকৃত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ঘরের বাইরে পাঁচিলের ধারে কলাগাছ, এখানে ওখানে আরও কয়েকটা গাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একধারের পাঁচিলে ঘুঁটে দেওয়া। সিংহদুয়ারের বাঁদিকটার কাছে পাঁচিলটুকু একটু খয়ে গেছে। উঠোনে একখানা খাট পাতা। গোপাল সেখানে বসে তার নাতি-নাতনীদের গল্প শোনায়।

গোপালের নাতি-নাতনিগুলো রাজ্যের বিচ্ছু। পুঁটি, ট্যাপা, পুঁচকে, ন্যাপলা, গুলটে পণ্ডিতমশায়ের পাঠশালায় পড়াশোনা করে আর সারাদিন পুরো গাঁয়ে ছুটে বেরিয়ে ডাঙ্গুলি খেলে বেড়ায়। গোপালের সহচর এই পঞ্চপাণ্ডব-পাণ্ডবীকে গোপাল আর তার বউ ভীষণ স্নেহ করেন। এরা আছে বলেই তো এই বৃদ্ধ দম্পতির সংসার একঘেয়ে হওয়ার বদলে আনন্দ আশ্রমে পরিণত হয়েছে।

গোপাল ভাঁড় রাজসভার বিদূষক হলেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে ছাড়া একদণ্ডও যেন চলতে পারেন না। গোপালের বুদ্ধির জোরে কতবার যে বনবাসী হওয়ার পরিস্থিতি থেকে বেঁচেছেন তার হিসেব করতে বসলে কৃষ্ণনগরের সব কালি ফুরিয়ে যাবে। আর এহেন কর্মের জেরে গোপাল রাজা-রানির প্রশংসা লাভ করলেও জুটিয়েছে মন্ত্রী আর ভগবানের মতো আর্চ-রাইভালদের। খ্যাংরাকাঠি দুষ্টুমন্ত্রীর সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে মহারাজকে অসীম বিপদ থেকে বারংবার রক্ষা করলেও, মহারাজ মন্ত্রীকে তার স্বপদে বহাল রাখবেনই রাখবেন। আরে এত বড় রাজ্যে কি মন্ত্রীর অভাব পড়েছে নাকি? কেন এ উল্লুকটাকে দুধকলা দিয়ে এখনো পুষছিস? দরকার হলে পাশের খাম্বাজরাজ্য থেকে মন্ত্রী ধরে আন না। না কেষ্টাব্যাটা ওসব করবে না। মন্ত্রীকে বারবার ক্ষমা করে দিয়ে এত এত দয়া আর ভালোবাসা দেখাবে যে স্বয়ং গান্ধীজিও এই ভালোবাসার জোরের কাছে ফেল মেরে যাবেন। তবে সত্যি কথা কইতে কি, মন্ত্রী আছে বলেই গোপালের ট্যাঁকে দুপয়সা বাড়তি আসে। মন্ত্রীর পয়সা সরানোর কুমতলব ধরিয়ে দিয়ে, মন্ত্রীকে ঘোল খাইয়ে, মহারাজের মন জয় করে (কখনো ঠকিয়ে) নিত্য টু-পাইস কামায় গোপাল। (চলবে)

[গুরুচণ্ডালী দোষ এযাত্রায় নিজগুণে ক্ষমা করবেন।]


1 comment:

Theme images by alacatr. Powered by Blogger.