গোপাল ভাঁড়ের গল্পলোকে
নদীয়ার রাজধানী কৃষ্ণনগর। সেখানে রাজত্ব করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। বিশাল প্রাসাদ তার, চৌদিকে বেষ্টিত ইষ্টকনির্মিত দেয়াল। চৌকোনা আকৃতির দ্বিতল প্রাসাদ প্রাঙ্গণে কত কী আছে! বাগান আছে, বাগানে বানর আছে, পাখি আছে। কত ফলের গাছ থেকে বাহারি সব ফল বাগানের ঘাসের গালিচায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আছে সরোবর সুন্দর। তাতে শতদলের সাথে খেলা করে মরাল। আর তার ধারে আছে শ্বেতপাথরের আসন। প্রতি সকালে মহারাজ বাগানে পায়চারি করেন প্রাতভ্রমণের উদ্দেশে। ব্রাহ্মমুহূর্তের বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে করতে মহারাজ বাগানের সদ্যোত্থিত পাখিসবের কলকাকলি শ্রবণ করিয়া সাধুসাধু রব তোলেন। আর গোধূলিপূর্বে বৈকালিক অবসরে সরোবরের ধারে বসিয়া স্নিগ্ধ সূর্যাস্তের শেষ আলোটুকু গায়ে মাখেন। বড়ই সুন্দর দেশের প্রজাবৎসল নৃপতির এই ছোট্ট রাজপাটটুকু নিতান্তই সাদাসিধে, তথাপি মনোহারিণী।
গোপাল ভাঁড়। ছবি সৌজন্য সনি আট |
আমাদের গোপালের বাড়িখানায় যেতে হলে নদীর দিকে যে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে, সেটা ধরে এগিয়ে যেতে হবে। তারপর দেখবেন মাটির পাঁচিল, আর খড়ের চালের সমন্বয়ে তৈরি সেই পর্ণকুটির। ঘরখানা আহামরি বড় কিছু নয়। একখানা তক্তপোশ, কয়েকটা কুলুঙ্গি; তার একটাতে জিনিসপাতি, তৈজসপত্র রাখে গোপালের বউ। আরেকটাতে অবস্থান নিয়ে গোপালে স্বর্গগত পিতৃদেবের মূর্তি সারাক্ষণ এই দম্পতি'র ওপর আশির্বাদের কটাক্ষ করে যাচ্ছেন। বিছানার দেয়ালের পাশটাতে আংটায় আটকানো গোপালের তৈলচিটচিটে জামাকাপড়। ঘরের একপাশে একখানা সিন্দুক। এই নির্বিত্ত দম্পতির যা-কিছু বিত্ত তা ওখানটাতেই যতনভরে রাখা আছে। আর আছে পূজো দেওয়ার স্থান, গৃহকর্মে নিপুণা গোপালের আটপৌরে বউটি সেই সিংহাসনে পূজো দেওয়ার আগে প্রতিদিন বাইরের তুলসীতলায় বাতি জ্বালিয়ে রেখে যায়।
গোপালের ঘরের খড়ের চালের দশা করুণ। মহারাজের কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে এই আকালের বাজারে নিজেদের পেট সামলানোই দায়। তার ওপর প্রতি বছরই নতুন করে চাল ছাওয়ানোর দরকার পড়ে। সেই চালের ওপর চালকুমড়োর মাচা পেঁচিয়ে আছে। নাদুস-নুদুস, কচি কচি চালকুমড়ো ঘরের চালের আশ্রয়ে রান্নাঘরের কড়াইয়ে উৎসর্গীকৃত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ঘরের বাইরে পাঁচিলের ধারে কলাগাছ, এখানে ওখানে আরও কয়েকটা গাছ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একধারের পাঁচিলে ঘুঁটে দেওয়া। সিংহদুয়ারের বাঁদিকটার কাছে পাঁচিলটুকু একটু খয়ে গেছে। উঠোনে একখানা খাট পাতা। গোপাল সেখানে বসে তার নাতি-নাতনীদের গল্প শোনায়।
গোপালের নাতি-নাতনিগুলো রাজ্যের বিচ্ছু। পুঁটি, ট্যাপা, পুঁচকে, ন্যাপলা, গুলটে পণ্ডিতমশায়ের পাঠশালায় পড়াশোনা করে আর সারাদিন পুরো গাঁয়ে ছুটে বেরিয়ে ডাঙ্গুলি খেলে বেড়ায়। গোপালের সহচর এই পঞ্চপাণ্ডব-পাণ্ডবীকে গোপাল আর তার বউ ভীষণ স্নেহ করেন। এরা আছে বলেই তো এই বৃদ্ধ দম্পতির সংসার একঘেয়ে হওয়ার বদলে আনন্দ আশ্রমে পরিণত হয়েছে।
গোপাল ভাঁড় রাজসভার বিদূষক হলেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে ছাড়া একদণ্ডও যেন চলতে পারেন না। গোপালের বুদ্ধির জোরে কতবার যে বনবাসী হওয়ার পরিস্থিতি থেকে বেঁচেছেন তার হিসেব করতে বসলে কৃষ্ণনগরের সব কালি ফুরিয়ে যাবে। আর এহেন কর্মের জেরে গোপাল রাজা-রানির প্রশংসা লাভ করলেও জুটিয়েছে মন্ত্রী আর ভগবানের মতো আর্চ-রাইভালদের। খ্যাংরাকাঠি দুষ্টুমন্ত্রীর সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে মহারাজকে অসীম বিপদ থেকে বারংবার রক্ষা করলেও, মহারাজ মন্ত্রীকে তার স্বপদে বহাল রাখবেনই রাখবেন। আরে এত বড় রাজ্যে কি মন্ত্রীর অভাব পড়েছে নাকি? কেন এ উল্লুকটাকে দুধকলা দিয়ে এখনো পুষছিস? দরকার হলে পাশের খাম্বাজরাজ্য থেকে মন্ত্রী ধরে আন না। না কেষ্টাব্যাটা ওসব করবে না। মন্ত্রীকে বারবার ক্ষমা করে দিয়ে এত এত দয়া আর ভালোবাসা দেখাবে যে স্বয়ং গান্ধীজিও এই ভালোবাসার জোরের কাছে ফেল মেরে যাবেন। তবে সত্যি কথা কইতে কি, মন্ত্রী আছে বলেই গোপালের ট্যাঁকে দুপয়সা বাড়তি আসে। মন্ত্রীর পয়সা সরানোর কুমতলব ধরিয়ে দিয়ে, মন্ত্রীকে ঘোল খাইয়ে, মহারাজের মন জয় করে (কখনো ঠকিয়ে) নিত্য টু-পাইস কামায় গোপাল। (চলবে)
[গুরুচণ্ডালী দোষ এযাত্রায় নিজগুণে ক্ষমা করবেন।]
This is a test comment.
ReplyDelete