ক্রাউডফান্ডেড জার্নালিজম: জনগণের অর্থে সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সবসময় জোর দেওয়া হয়। সাংবাদিকতার স্কুলগুলোতে এ পেশার নীতিশাস্ত্র বিশেষভাবে জোর দিয়ে পড়ানো হয়। প্রতিটি সংবাদসংস্থাগুলো তাদের হাউজ পলিসিতে বস্তুনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কথা উল্লেখ করে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও নৈতিক সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ যারা সাংবাদিকতা করছেন, তারা যে একেবারে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন তা কিন্তু মোটেও নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে কাজ করলে রাষ্ট্রের কথা শুনে চলতে হয় বেশিরভাগসময়ই, বিশেষত পূর্ববিশ্বের দেশগুলোতে সাংবাদিকতার ওপর রাষ্ট্রের প্রভাব উল্লেখ করার মতো। এটা শুনে অনেকে বলবেন, বেসরকারিভাবে পরিচালিত সংবাদসংস্থাগুলোকে তো আর রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে না বা রাষ্ট্রকে ভয় করতে হচ্ছে না। তাহলে তো তারা সহজেই বস্তুনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার চর্চা চালিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু মুক্তগণমাধ্যমের চর্চা পূর্ববিশ্বের দেশগুলোতে সোনার হরিণ, এখানে বেসরকারি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোকেও সরকারের অঙ্গুলি হেলনের সাথে তাল-সুর-লয় মেলাতে হয়। তা না হলে এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এবার অনেকের কাছে মনে হতে পারে, উন্নত পশ্চিমাবিশ্বের নৈয়ায়িক সরকারেরা তে সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ করেন না। করলে কি আর ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা মানুষ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতো? এ কথাটা ঠিক বলে মেনে নিলেও তা-ই বলে যে উন্নত বিশ্বের সাংবাদিকতা শতভাগ ফেয়ার, তাও কিন্তু বলা যাবে না। নোম চমস্কি আর এডওয়ার্ড হারম্যান অনেক আগেই পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছেন কী করে বেসরকারি সাংবাদিকতাও দূষিত হতে পারে। তাদের প্রোপাগান্ডা মডেলে তারা দেখিয়েছেন কীভাবে বেসরকারি আয়ত্তাধীন সাংবাদিকতাকেও ঝেড়েপুছে, কর্তৃপক্ষের মনের মতো করে সাজিয়ে আমাদের সামনে হাজির করা হয়। তাহলে কী আসলে কোনোভাবেই প্রভাবমুক্ত, বস্তুনিষ্ঠ, সৎ সাংবাদিকতা করার কোনো উপায় নেই? কারণ এ কাজটা করতে হলে প্রচুর টাকাপয়সা দরকার। বিজ্ঞাপন দিয়ে আর কাগজ বেচে ক'পয়সাই বা আয় হয়? তা দিয়ে তো বিশাল মিডিয়া হাউজ চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং সাংবাদিকতার জ্বালানির জন্য হয় রাষ্ট্র, নয়তো বেসরকারি সংগঠনের কাছে হাত পাততে হবে। এবং তারপর 'যার নুন খাই, তার গুণ গাই' নীতি মেনে চলতেই হবে। এমন কোনো 'গৌরী সেন' নেই যে কোনো চাহিদা বা উদ্দেশ্য ছাড়াই সাংবাদিকতার পেছনে টাকা ঢালবে? তবে কি ফ্রি প্রেস একটা মিথ?
ক্রাউডফান্ডেড জার্নালিজম। ছবি সৌজন্য ইউটিউব/দ্য অডিওপিডিয়া |
ক্রাউডফান্ডেড জার্নালিজম কী?
সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে সঠিক খবরটা জানানো। তার জন্য চাই গণমাধ্যমের অবাধ চর্চা। কিন্তু ওপরের দুপক্ষই তা দিতে রাজি নয়। কিন্তু কেমন হয় যদি, যাদের জন্য সাংবাদিকতা, তারাই এর দায়িত্ব নেয়? মানে খরচটা যদি জনগণের কাছ থেকে ওঠে তাহলে তো আর কোনো পক্ষের চোখ রাঙানি নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই! এখানেই ক্রাউডফান্ডেড জার্নালিজমের মূল ধারণাটা নিহিত। একটা মিডিয়া হাউজের মূলধন, খরচ সব উঠে আসবে জনগণের পয়সা থেকে। যারা ব্রেকিং ব্যাড নামের টিভি সিরিজটি দেখেছেন, তারা দেখেছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার চিকিৎসার জন্য ছেলে ইন্টারনেটে একটি ফান্ডরাইজিং ওয়েবসাইট খুলেছে। বাবাকে নিয়ে ছেলের আবেগপূর্ণ লেখা আর সাহায্যের আকুতি দেখে অনেকেই টাকাপয়সা দান করেছেন সেই ওয়েবসাইটে। এরকম ক্রাউন্ডফান্ডিং নানা কাজের জন্য করা হয়। সাংবাদিকতাও বাদ থাকে কেন! সাংবাদিকতার ক্রাউডফান্ডিং-এর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি অনুদানের আহ্বান জানানো হয়। এই অর্থসাহায্য হতে পারে শুধু একটি নিউজ স্টোরির জন্য বা নতুন একটি নিউজ প্লাটফর্ম তৈরি করার জন্য। ক্রাউডফান্ডিং-এর কাজটি করা হয়ে ইন্টারনেট তথা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বে শতশত ক্রাউডফান্ডিং সাইট আছে এবং এ সাইটগুলোর মোট উত্তোলিত অর্থের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার।
সাংবাদিকতার জন্য মানুষ কত টাকাই বা দিতে ইচ্ছুক? এ বিষয়ক বেশিরভাগ ক্রাউডফান্ডিং প্রজেক্টে হাজার থেকে অযুত পরিমাণ ডলারের দেখা মিলেছে। কিন্তু কিছু প্রজেক্টে অবিশ্বাস্য সাফল্য পাওয়া গেছে। গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে ইউরোপে তিনটি ক্রাউডফান্ডিং প্রজেক্টের দ্বারা প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার উত্তোলন করা হয়েছে। হল্যান্ডের দে করেসপন্ডেন্ট, জার্মানির ক্রাউটরিপোর্টার, এবং স্পেইনের এল এসপানোল- এ তিনটি সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি ক্রাউডফান্ডিং-এর অর্থে গড়ে উঠেছে।
ক্রাউডফান্ডিং কীভাবে করবেন?
সাংবাদিকতার জন্য ক্রাউডফান্ডিং শুনতে কিছুটা কঠিন আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে। জিআইজেএন-এর গাইডলাইনে কিছু উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে ক্রাউডফান্ডিং-এর ব্যাপারে।
- প্রথমে দেখতে হবে ওয়েবসাইট। কোন ওয়েবসাইট আপনার জন্য ভালো হবে তা খুঁজে বের করতে হবে। একই সাথে অডিয়েন্সের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে (যারা দাতা, তারাই অডিয়েন্স)। এরপরে দেখতে হবে ওই সাইটের নিয়মকানুন, খরচাপাতি (নিবন্ধন খরচ, মাসিক ফি, অর্থ স্থানান্তর খরচ) ইত্যাদি। এর বাইরে ভাবতে হবে ডেডলাইন নিয়ে অর্থাৎ ঠিক কতদিনের মধ্যে আপনি আপনার ঈপ্সিত অর্থ তুলতে চান। আর আপনার পরিচিত কেউ যদি আগে এ অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত থাকেন, তাহলে তার কাছ থেকে সেসব শুনতে হবে।
- এর পরের কাজ হচ্ছে পিচ তৈরি। পিচ (pitch) মানে হচ্ছে সংবাদের উপস্থাপনা। তবে এখানে পিচ অর্থ হচ্ছে আপনি আপনার ফান্ডরাইজিং-এর কারণ হিসেবে যে বার্তাটি সবাইকে জানাতে চান তা। অর্থাৎ আপনি কেন অর্থসাহায্য চাইছেন, আপনি কী ধরনের সাংবাদিকতার জন্য সাহায্য চাইছেন, যারা আপনাকে সাহায্য করছে তারা এ প্রজেক্টের সাথে কীভাবে জড়িত বা কীভাবে পরে যুক্ত হতে পারেন এসব উল্লেখ থাকবে আপনার পিচে। পিচ কনটেন্টের বার্তাটি হতে হবে সহজবোধ্য, সরল, সংক্ষিপ্ত, ও সৃজনশীল। পিচটি হতে পারে ভিডিও, ইনফোগ্রাফ, বা লেখা।
- ক্রাউডফান্ডিং মানে যে পুরো ব্যাপারটিই আগাগোড়া আর্থিক তা কিন্তু মোটেও নয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ক্রাউডফান্ডিং-এর অন্যান্য গুরুত্বও আছে। এর মাধ্যমে একটা বিশাল গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত থাকা যায়, সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করা যায়, যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। তাই ক্রাউডফান্ডিং-এর মাধ্যমে আপনি ইচ্ছে করলে মানুষের কাছ থেকে টাকার বদলে অন্য কিছু সাহায্য চাইতে পারেন। কেউ আর্থিক সাহায্য না করতে পারলে কনটেন্ট দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। অনেকে আবার অন্যান্য সোর্স, রিসোর্স, কন্টাক্টের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন। যেহেতু ক্রাউডফান্ডিং-এর লক্ষ্য হলো সবাইকে নিয়ে, সবার জন্য, সবার দ্বারা সাংবাদিকতা- তাই মানুষের কাছ থেকে সবধরনের সম্ভাব্য সহায়তাই গ্রহণ করা উচিত।
- এছাড়া প্রয়োজন সংযোগের। যত বেশি সম্ভব তত বেশি মানুষের কাছে আপনার প্রজেক্টের কথা পৌঁছাতে পারলে ভালো হয়। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। আর আপনার টার্গেট অডিয়েন্সকে আহ্বান করা যেতে পারে যাতে তারা যেন এ প্রজেক্টটির কথা তাদের পরিপার্শ্বের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
- টাকা পেয়ে গেলেই কাজ শেষ নয় বরং আসল কাজ এবার শুরু হলো বলে। আপনার পরিকল্পিত অর্থ উত্তোলিত হওয়ার পর দাতাদেরকে জানাতে হবে ওই অর্খ আপনি কীভাবে, কোথায় খরচ করেছেন। এরপরের কাজ হচ্ছে আপনার দাতাদের নিয়ে নাগরিক সাংবাদিকতা শুরু করা। তাদের কাছ থেকে লেখা, আইডিয়া, রিসোর্সেস, লজিস্টিকস চাওয়া যেতে পারে।
ক্রাউডফান্ডিং ওয়েবসাইটস
কিকস্টার্টার আর ইন্ডিগোগো অনেক বিখ্যাত দুটি ক্রাউডফান্ডিং সাইট। কিন্তু এর বাইরেও অনেক সাইট আছে যেগুলো সাংবাদিকতার ক্রাউডফান্ডিং নিয়ে কাজ করে থাকে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্রাউডফান্ডিং প্লাটফর্ম হচ্ছে প্যাট্রিয়ন, ক্রাউডফান্ডার, গুগল কনট্রিবিউটর, ফেইসবুক ফান্ডরাইজারস, কো-ফি ইত্যাদি। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রাউডফান্ডিং সাইট হচ্ছে তাইওয়ানভিত্তিক ফ্লাইয়িং ভি।
No comments