Header Ads

Header ADS

পলিটিক্যাল কার্টুনকথন

কার্টুন দেখতে কে না পছন্দ করে! আঁকাবাঁকা, কিম্ভূতকিমাকার দৃশ্যগুলো কখনোই আমাদের আনন্দ যোগাতে ব্যর্থ হয় না। কিন্তু কার্টুন নিয়ে আমাদের একটি গৎবাঁধা ধারণা আছে; কার্টুন মানেই ছেলেমানুষী ব্যাপারস্যাপার, কার্টুনের বিষয়বস্তু সবসময় হাস্যরসাত্মক। না, ব্যাপারটি একদম তা নয় বরং কার্টুনই অনেক সময় তেতো সত্য প্রকাশ করার সবচেয়ে কার্যকরী আর শক্তিশালী উপায় হয়ে ওঠে। যেসব কথা মুখে বলা যায় না বা লিখে প্রকাশ করা যায় না, সেসব অনায়াসে কার্টুনের সাহায্যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর যখন ব্যাপারটি হয় রাজনৈতিক, তখন রাবণরাজাদের রোষ থেকে লেজ বাঁচিয়ে লঙ্কাপোড়ানোর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র বা পলিটিক্যাল কার্টুন। পলিটিক্যাল কার্টুনের সাহায্যে অনেক অপ্রিয় সত্যিকে প্রকাশ করা যেতে পারে, শাসকের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, স্বৈরাচার বা যেকোনো প্রকারের রাজনৈতিক বিকৃতাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেতে পারে। ব্রিটানিকা'র সংজ্ঞা অনুযায়ী, পলিটিক্যাল কার্টুন হচ্ছে, এমন ধরণের ড্রয়িং (বেশিরভাগ সময় ক্যারিকেচার সহযোগে) যার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনীতি, রাজনীতিবিদ, এবং চলমান ঘটনাসমূহের ওপর সম্পাদকীয় মতামত জানানো। হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময় পলিটিক্যাল কার্টুন সম্পাদকীয় পাতায় সম্পাদকের কলামের সাথে বা অপ-এড পাতার রাজনৈতিক নিবন্ধের সাথে প্রকাশিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক সময় ছবির বদলে তার জায়গায় পলিটিক্যাল ক্যারিকেচার সংযুক্ত করা হয়।

Join or Die
ফ্রাঙ্কলিনের আঁকা কার্টুন
ইতিহাস ঘটলে দেখা যায়, পলিটিক্যাল কার্টুনের জন্ম আমেরিকার জন্মেরও আগে। আর এই কার্টুনটির জন্মদাতা আমেরিকার অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তিনি তার পেনসিলভেনিয়া গ্যাজেট-এ ১৭৫৪ সালের ০৯ মে তারিখে 'জয়েন, অর ডাই' নামের একটি কার্টুনটি আঁকেন। কার্টুনটি ছিল মূলত একটি আট টুকরো করে কাটা সাপের চিত্র। কলোনিয়াল আমেরিকার রাজ্যগুলোকে একত্র হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন এ কার্টুনটির মাধ্যমে। অর্থাৎ, একতাই বল, বিভেদে পতন। আমেরিকাকে বাঁচতে হলে একত্রিত হয়েই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। সেই থেকেই আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় পলিটিক্যাল কার্টুন অহরহ দেখা যেত। আজকের দিনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোতে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশে কোনো ক্লান্তি দেখা যায় না।

কার্টুনের আরেকটি চমৎকার গুণ হলো অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদেরও কার্টুন বুঝতে অসুবিধে হতো না খুব একটা। তাই পত্রিকা না পড়তে পারলেও মানুষ কার্টুন দেখেই মেসেজ ধরতে পারত। ফাঙ্কলিনের কার্টুন এই কাজটা খুব ভালো করেই করেছিল। কারণ সেই সময় আমেরিকাতে শিক্ষার হার খুব বেশি ছিল না, কিন্তু তার কার্টুনের বার্তাটুকু ঠিক ঠিক পৌঁছেছিল মানুষের কাছে।

ম্যাট উয়ের্কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিকো-তে কাজ করেন কার্টুনিস্ট হিসেবে। ২০১২ সালে কার্টুন এঁকে পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছেন। তার কাছে কার্টুন আঁকার কাজটা কিছুটা অদ্ভুত বলে মনে হয়।

আমরা এক অদ্ভুত মিশ্রিত সত্ত্বা এ কারণে যে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা প্রকাশ করি, কিন্তু এই প্রকাশের কাজটা আমাদেরকে খুব সিরিয়াসলি করতে হয় না।

উয়ের্কার মনে করেন ব্যাপারটা খুবই মজার যে টেলিভিশনের বক্তা বা সংবাদপত্রের কলামিস্ট, এদের মতোই কার্টুনিস্টরাও নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু তাদেরকে এই কাজটা করতে হয় কিছু ‘বোকা বোকা ছবি’র মাধ্যমে।

Matt Wuerker
ম্যাট উয়ের্কার। ছবি সৌজন্য ভোয়া
উয়ের্কার তার জীবনের একটা বিশাল অংশ পলিটিক্যাল কার্টুন এঁকে পার করেছেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের এই কর্মজীবনে তিনি অনেক পরিবর্তন দেখেছে এই শিল্পে। দেখেছেন কীভাবে কার্টুনগুলোর প্রকাশভঙ্গী সময়ের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে। আগে কার্টুন আঁকা হতো সাদাসিদাভাবে, সাদা-কালোর ছাপে। কিন্তু আজকাল রঙিন কার্টুনও আঁকা হচ্ছে হামেশাই। অবশ্য রঙিন কার্টুনের বয়সও কম হয়নি। সেসব ছাপিয়ে এখন তৈরি হচ্ছে অ্যানিমেটেড কার্টুন। কখনো কখনো কার্টুনিস্টরা একটি কার্টুনের বদলে বরং কার্টুনের সিরিজ আঁকছেন যার মাধ্যমে বলা হচ্ছে পুরো একটি গল্প। ২০১৮ সালে এরকম একটি কমিক গল্প পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছে। ‘ওয়েলকাম টু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এই কার্টুনটির গল্প সিরিয়ার দুই শরণার্থী পরিবারের যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। এই কার্টুন কালেকশনটি এঁকেছেন মাইখেল স্লোয়ান ও জেক হালপের্ন।

ধর্মীয় গোঁড়ামি, যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, ধনী-গরীবের বৈষম্য, জাতিবিদ্বেষ, সমাজের অমানবিকতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, উগ্র-দেশপ্রেম- কোন বিষয়ে বাদ গেছে কার্টুন আঁকা? সংবাদমাধ্যমে কার্টুন যেমন সিরিয়াস বিষয়গুলোকে শ্লেষাত্মকরূপে ফুটিয়ে তুলেছে তখন আবার একই সাথে কমিক রিলিফ হিসেবেও কাজ করেছে। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক কার্টুন একইসাথে একজন মানুষকে মনোবেদনা দিতে পারে, আবার হাসাতেও পারে। কার্টুন একটি বৈশ্বিক ভাষা। তাই পৃথিবীর সব দেশেই পলিটিক্যাল কার্টুনের বেশ চল রয়েছে। বাংলাদেশেও পলিটিক্যাল কার্টুনের ভাণ্ডার কম সমৃদ্ধ নয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে সংবাদমাধ্যমগুলোতে যেসব কথা সোজা বাংলায় লেখা যায় না, বা সরাসরি কাউকে নির্দেশ করা যায় না, সেসব ক্ষেত্রে কার্টুনিস্টরা তাদের সৃষ্টির সাহসী ব্যবহার করেছেন। তবে কার্টুন এঁকে প্রাণ হারানোর মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। তা-ই বলে থেমে যায়নি কার্টুন আঁকার চর্চা। বরং রাজনীতির ভ্রষ্টাচারকে আমজনতার সামনে তুলে ধরতে পলিটিক্যাল কার্টুনিস্টরা ভবিষ্যতেও সমানতালে তাদের কাজ নিঃসন্দেহে করে যাবেন।

তথ্যসূত্র
VOA News

No comments

Theme images by alacatr. Powered by Blogger.