...এন্ডিং থিংস, কনফেশন, এবং অনুভূতি
ক্বাফম্যানের সিনেমা আগে দেখা হয়নি কখনো। কারণ আমার সিনেমা সন্দর্শনের বয়স খুবই কম, তাই অনেক বিখ্যাত ফিল্মমেকারের সিনেমা দেখার সৌভাগ্য এখনো হয়ে ওঠেনি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে আমরা যারা সিনেমা দেখি, তারা পপ কালচার সিনেমাগুলোতেই বেশি মত্ত থাকি। অবশ্য এর বাইরে একদল আছে যারা সত্যিকার অর্থেই সিনেমা বিষয়ে ওয়াকিবহাল, সিনেমাটা বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখানে দুই শ্রেণির দর্শক আছে; এক যাদের দৌড় তারান্তিনো, স্করসেজি, নোলানদের মতো অতি জনপ্রিয় পরিচালকদের সিনেমা অব্দি। আর নতুন বের হওয়া, সিনেমা গ্রুপে জনপ্রিয় হওয়া ওয়ার্ড-অভ-মাউথ সিনেমাগুলো দেখা। আমি এ শ্রেণির দর্শক। সিনেব্রো হওয়ার সাধ আছে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
কী হচ্ছে এখানে! Image: Likely Story |
আরেক শ্রেণির দর্শক আছে যারা সিনেমাকে ভালোবাসে মন থেকে। তাই তাদের কোনো বাছবিচার নেই। এরকম ফিল্মি ফ্যান্টাসি তৈরি করাটা কিছুটা কঠিন। কারণ প্রচুর সময়ের দরকার, আর তার সাথে ফিল্ম নিয়ে প্রচুর পড়ালেখা করাটাও খুব প্রয়োজন। সিনেমার ইতিহাসের বয়সটা কম হলেও একে নিয়ে এত চর্চা হয়েছে যে সিনেমা বিষয়টা পুরোপুরি একটা আলাদা স্কুল হয়ে উঠেছে। সিনেমা বুঝতে হলে এসব নিয়েও একটু নাড়াচাড়া করা দরকার।
ক্বাফম্যানের কথা বলছি কারণ তার আই'ম থিঙ্কিং অভ এন্ডিং থিংস দেখা হলো সেদিন। সিনেমার স্টাইল প্রসঙ্গে বলার সাধ্য নেই এ জন্য যে ভদ্রলোকের কাজের ধাঁচ নিয়ে কিছুই জানা নেই। আর এ সিনেমাটাও এত বেশি একসেন্ট্রিক, আর সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ যে মাথার ভেতর সব জট পাকিয়ে গেছে। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হিসেবে এরকম নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভের চাতুর্য সত্যিই চমৎকৃত হওয়ার মতো। বিশেষত দেখার সময় ক্রিস্টফ নোলানের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু নোলানের কাজগুলোতে শেষ অব্দি এসে নাছোড়বান্দা দর্শক চেষ্টা করলে সিনেমার মায়াজাল ছাড়াতে পারেন কিন্তু ক্বাফম্যানের এ কীর্তিতে শেষেও শাঠ্য! বুঝবার জো নেই কোথা থেকে কী হচ্ছে, কী হলো, কেন হলো!
দেখার পর অবশেষে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলাম এতক্ষণ কী দেখলাম তা বোঝার জন্য। অনেকগুলো সাইটই আমাদের মতো অবুঝ, কচি'র কথা ভেবে দয়াপরবশ হয়ে সিনেমাটাকে আগাগোড়া ব্যাখ্যা করে রেখেছে। ভ্যানিটিফেয়ার-এর বিশ্লেষণটা সবার আগে চোখে পড়ল। তা পড়ে যা বুঝলাম, পুরো সিনেমাটাই ঝুট। মানে শতকরা ৯০ ভাগ ঝুট, অবাস্তব, অভূতপূর্ব, স্রেফ কল্পনা। বাকি ১০ ভাগ সত্য, কিন্তু সেটা ড্রপসিনের আড়ালে। অর্থাৎ পাক্কা দুঘন্টা একটা মিথ্যেতে আটকে ছিলাম! সিনেমা ব্যাপারটিই মিথ্যে কিন্তু সে মিথ্যেকে যখন এত জারিজুরি করে আবার সিনেমার ভেতর প্রচার করা হয় তখন বিষয়টা যেন আরও বেশি তালগোল পাকিয়ে যায় না?
কিন্তু চতুর পরিচালক বা লেখকের চিন্তাধারার গণ্ডি আমাদের চেয়ে ঢের ঢের বিস্তৃত। তাই মনে হয়, এভাবে একেবারে চট করে ঝুট বলে বাতিল করা যাচ্ছে না। পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাকারক জানাচ্ছেন, আদতে যেটা ঝুট বলে বিবেচ্য হচ্ছে সেটার উৎপত্তি আসল থেকেই। মানে জেক আর প্রৌঢ়া দুজনেই মিথ্যে হলেও তাদের উৎপত্তি ওই ঝাড়ুদার ভদ্রলোকের অতৃপ্ত আত্মার কাছ থেকে?
কথাটা ভৌতিক শোনাতে পারে? যদি তা-ই শোনায়, সেটাই সঠিক কারণ এই মনস্তাত্ত্বিক খেলাটা কখনো কখনো গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দিয়েছে বৈকি। জ্যানিটর মহাশয়ের জীবনটা সফল কিছু নয়। তিনি তার জীবনে সফল হতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু তা-ই বলে তিনি যে সফল একটি জীবনের আশা করতে পারেন না, তা তো নয়। একাকী, বৃদ্ধ, অক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে থাকা এই বৃদ্ধি এখনো টিকে আছেন তার এই স্বপ্নের ওপর ভর করে। জেক হচ্ছে তার পরিশীলিত, চিরকাঙ্ক্ষিত অ্যাভাটার। তিনি যেমনটা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি, সেটাকেই তিনি কল্পনায় জীবন দিলেন। সে অ্যাভাটারের সাথে জুড়ে দিলেন নিজের সব শখ, জ্ঞান, আবেগ, ইন্দ্রিয়। সাথে তৈরি করে নিলেন এক সঙ্গী, এক ইমেজিনারি ফ্রেন্ড, স্বভাবতই নারী; কারণ নারীত্বের শক্তিতেই পৌরুষ এগিয়ে চলে। এখানে তার দোষের কিছু নেই, আমরা সবাই আমাদের জীবনে এ কাজটা করে থাকি।
আমরা জীবনে যেমনটা হতে চাই, তা কয়জন-ই-বা পারি? অভীষ্ট জীবন ভীষণ কঠিন, আর তা গড়ে ওঠে কল্পনার ওপর নির্ভর করে। ফলে আমরা আমাদের মননে আমাদের আপডেটেড, আপগ্রেডেড ভার্সনকে এমন এক অ্যাভাটারে তৈরি করি যার কথা চিন্তা করে আমাদের না পাওয়ার গ্লানিকে প্রশমন করি। এইযে আমি, ইউটিউবে স্ট্রিমারদের দেখে আমারও ইচ্ছে হয় তাদের মতো জনপ্রিয় স্ট্রিমার হতে। নাহ, হতে নয়, আমি বরং ভাবি ইশ কেন এমনটা হলাম না, হতে পারলাম না। তারপর যে ভাবনাটা মনে আসে, এমনটা হতে পারলে আমার জীবনটা কেমন হতো? আর তখনই আমার মনে তৈরি আমার নিজের 'জেক' রূপ। একজন স্ট্রিমার হিসেবে আমি নিজেকে কল্পনা করতে শুরু করি।
হয়তো প্রশ্ন হতে পারে, জ্যানিটর যদি তার নিজের ঈপ্সিত জীবনকে জেকের মধ্য দিয়ে ভাবছে, তাহলে সে জেককে আরও শ্রেষ্ঠ বানালো না কেন? মানে, এই ধরা যাক, বিশালবপু জেকের বদলে বলিষ্ঠ ঋজুদেহ জেক। বা আরও একটু দামী গাড়ি? কেন নয়? কারণ আমাদের চিন্তার একটা পরিসীমা আছে। এর বাইরে ভাবতে গেলে আমরা একটু অস্বস্তি বোধ করি। আর কতটুকুু মহৎ বা বিস্তৃত করে ভাববো তারও একটু সীমাবদ্ধতা থাকে বৈকি। এই যেমন, স্ট্রিমার হিসেবে নিজেকে ভাবতে গেলে আমি যেরকমটা ভাবি, তার সাথে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্ট্রিমার নিনজা বা শ্রাউডের জীবনব্যবস্থার সাথে কোনো মিল নেই। কারণ আমি তাদের জীবনযাপন কেমন তা জানি না। স্ট্রিমিং-এর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার পরিস্কার ধারণা নেই। তাই আমি নিজেকে যেরকম একজন স্ট্রিমার ভাবছি, তার সাথে হয়তো বাস্তব জীবনের একজন স্ট্রিমারের কোনো মিল নেই।
জ্যানিটরের জীবনবোধ, তার দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু বা যে মাত্রায় সেসব অধিষ্ঠান করে, তার কল্পনার জগৎটাও সেরকম একটা মাত্রার ভেতর সীমিত। তাই তিনি তার বান্ধবীকে আরও বেশি 'সুদর্শনা' (একটু বিতর্কের বিষয় বটে সৌন্দর্যের পরিমাপ, তাও তর্কের খাতিরে মেনে নিচ্ছি ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই রোজামন্ড পাইকের মতো মনোহারিণী নন) করতে ইচ্ছেবোধ করেননি। কিন্তু তার বান্ধবীকে তিনি ইচ্ছেমতো জ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন শাখায় বিচরণ করিয়েছেন; কখনো পদার্থবিদ, কখনো চিত্রবিদ, আবার কখনো অন্যকিছু। কারণ, এ সবগুলো বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে, তাই তিনি তার কল্পনার সহযাত্রীকে নিজের সুবিধামতো সময়ে সময়ে পাল্টিয়ে নিয়েছেন।
এত আজগুবি আলাপ, পড়াশোনা, বা চিন্তার পরও শেষটা বোঝা গেল না। আ বিউটিফুল মাইন্ড-এর কথা মনে পড়ে গেল শেষে এসে। জেকের ঘরে একটা কপি দেখেছিলাম সিনেমাটার। তবে কি জ্যানিটরের মনের কোনো সুদূর কোণে লুকোনো কোনো আশা ছিল যে তার শেষ জীবনটাও জন ন্যাশের মতো হবে? জীবনভর গ্লানির ভার কিন্তু শেষটা সুখকর? শেষ নিয়ে আর মাথা ঘামানো না যাক। দারুণ শীতল সিনেমাটোগ্রাফি, দুই মুখ্য অভিনেতার চতুর সংলাপ ছোঁড়াছুড়ি, কিছু রহস্যময় শটস; এসব মিলিয়ে সিনেমাটা বেশ উপভোগ করেছি। ওটাই আসল ব্যাপার।
এ লেখাটা লেখা হয়েছে একজন সাধারণ দর্শকের চোখে; কোনো সিনেম্যাটিক প্যারামিটারের কথা মাথায় রেখে নয়।
No comments