Header Ads

Header ADS

অ্যালান স্মিদি: হলিউডের 'কালেক্টর সাহেব'

ফেইসবুকের কল্যাণ, 'কালেক্টেড' শব্দটা আমাদের খুব পরিচিত। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে এই 'কালেক্টর সাহেব' পোস্ট করেছেন ফেইসবুকে। কেউ জানে না কালেক্টেড-এর মূল পরিচয় কী। কিন্তু তারপরও যথেষ্ট বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন এই ভদ্রলোক। তার পোস্টগুলো কুড়িয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন রিয়্যাকশন। অসংখ্য কমেন্টের ভেতর কখনো তিনি প্রশংসায় ডুবেছেন, আবার কখনো তীব্র শ্রাব্য-অশ্রাব্য বাক্যবাণে জর্জরিত হয়েছেন। এ হেন গালি নেই তার কপালে জোটেনি। তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। তাকে এখনও হরহামেশাই দেখা যায় ফেইসবুক। নিয়মিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন, সাময়িক, ভাইরাল, ন্যাকাষষ্ঠী ইত্যাদি প্রকারের বিষয় নিয়ে তিনি তার কীর্তি প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

Image Source: scriptmag.com
জোক্স অ্যাপার্ট, ফেসবুকে কালেক্টেড পোস্ট-এর মানে হচ্ছে উক্ত পোস্টটি কেউ একজন করেছেন কিন্তু তার নাম-পরিচয় অডিয়েন্স জানেন না। সোশাল-মিডিয়ায় ব্যক্তির লেখা চুরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার কারণ এখানে যদু, মধু, রাম, সাম সবাই এক একজন হরিদাস পাল হয়ে যান। তাই অন্যের জিনিস অনেক সময় অন্যের নামে প্রকাশ করতে ব্যক্তির আঁতে ঘা লাগতেই পারে। তাই সেটাকে সংগৃহীতের (পড়ুন সংগ্রিহীত) বলে চালিয়ে দিলে সব ল্যাঠা চুকে যায়। চুরিও হলো না, আবার নিজের বলে দাবী করাও হলো না। জেনে অবাক হবেন, কোনো একসময় হলিউডে অনেকটা এরকম একটি পন্থা প্রচলিত ছিল। তখন অনেক সময় সিনেমার পরিচালকের নামের জায়গায় পরিচালকের নাম না থেকে 'কালেক্টেড' বসিয়ে দেওয়া হতো। আহ্, একটু ভুল হলো। হলিউডের এই কালেক্টর সাহেবের নাম ছিল 'অ্যালান স্মিদি' (Alan Smithee)।


অ্যালান স্মিদি?

ডেভিড লিঞ্চের মনোহারিণী (মাইন্ডফা* অর্থে) সিনেমা মুলহল্যান্ড ড্রাইভ দেখে থাকলে আপনি নিশ্চয়ই অ্যাডাম কেশার-কে চেনেন? কেশার হলিউডের পরিচালক। তার নির্মাণাধীন সিনেমার কর্তাব্যক্তিরা ও স্থানীয় মাফিয়ারা তাকে নিজের মতো করে নায়িকা বাছতে দেবে না বরং তাদের নির্বাচন করে দেওয়া অভিনেত্রীকেই সিনেমায় নিতে হবে। অর্থাৎ একজন পরিচালক হিসেবে কেশার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন না। তার চেয়ে বড় কথা হলো, প্রোডাকশন হাউজ, নায়িকা বাছাই করতে না দিয়ে, তার সৃজনশীলতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, কেশার সিনেমাটি পরিচালনা করছেন বটে কিন্তু সেখানে তার তেমন কোনো কর্তৃত্ব নেই, তার সৃজনশীলতা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় (সিনেমার ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে বলছি) কেশার ইচ্ছে করলে সিনেমাটির পরিচালক হিসেবে নিজের নাম প্রত্যাহার করতে পারতেন। অর্থাৎ সিনেমার সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতা না রাখতে চাইলে সেটা তিনি করতে পারতেন। আর তাকে এ কাজে সাহায্য করার জন্য সদাপ্রস্তুত রয়েছেন আমাদের অ্যালান স্মিদি সাহেব।

১৯৬৯ থেকে ২০০০ সাল, প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে হলিউডে প্রায় ৪০টির মতো 'কাজ করেছেন' অ্যালান স্মিদি। এখনো বিভ্রান্ত বোধ করলে বলি শুনুন, সে সময় যদি কোনো ডিরেক্টর বা রাইটার (তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিরেক্টর) কোনো সিনেমা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করতে চাইতেন, সেক্ষেত্রে তাকে একটি ছদ্মনাম দিতে হতো। এই ছদ্মনামটিই হচ্ছে অ্যালান স্মিদি। অর্থাৎ অ্যালান স্মিদি বলে বাস্তবে কেউ কখনো ছিল না। পুরোপুরি অজ্ঞাতকুলশীল এ ব্যক্তি অনেকটা বর্তমান ফেইসবুকের 'কালেক্টর সাহেবে'র মতো কাজ করতেন। সবাই জানে কাজটি অ্যালান স্মিদি/কালেক্টেড করেছেন, কিন্তু কেউ জানে না বাস্তবের অ্যালান স্মিদি/কালেক্টেড-এর পেছনে কে আছে।

স্মিদি'র জন্ম

তো কীভাবে জন্ম নিলেন এই অ্যালান স্মিদি সাহেব? জানতে হলে চলে যেতে হবে অনেক পেছনে। ১৯৬৯ সালের কথা। ডেথ অভ আ গানফাইটার সিনেমার শ্যুটিং চলছিল তখন। ওয়েস্টার্ন ঘরানার সিনেমাটি পরিচালনা করছিলেন রবার্ট টটেন। কিন্তু তার সাথে মনোমালিন্য হয় সিনেমার নায়ক রিচার্ড ওয়াইডমার্কের। ব্যাস, রিচার্ড ঠিক করলেন তিনি আর টটেনের সাথে কাজ করবেন না। ২৫ দিন কাজ করা টটেনের জায়গায় ডন সিজেল-কে আনানোর ব্যবস্থা করলেন রিচার্ড (হিরো'র প্রচুর ক্ষমতা, তা-ই না?)। ডন সিজেল শ্যুটিং করলেন বাকি ১০ দিন।

সিনেমা তো তৈরি হলো, কিন্তু পরিচালক কে হবে? সিজেল আর টটেন, দুজনই পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। এমন অবস্থায় ডিরেক্টর্স গিল্ড অভ আমেরিকা (ডিজিএ) পড়লো মহাফ্যাসাদে। এই অভূতপূর্ব অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ডিজিএ ঠিক করলো পরিচালকের জায়গায় কোনো ছদ্মনাম ব্যবহার করা হবে।

কিন্তু নামটা কী হবে? এমন একটা নাম চাই যেটা দেখতে স্বতন্ত্র অথচ শুনতে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। আবার এমন হতে হবে যেন নাম দেখে কেউ ভ্যাবাচ্যাকা না খায়। আর এভাবেই জন্ম হলো অ্যালান স্মিদি সাহেবের।

নামগোত্রহীন হলেও স্মিদি সাহেব কিন্তু মোটেও 'ফালতু' ছিলেন না। ডেথ অভ দ্য গানফাইটার দেখে বিখ্যাত চলচ্চিত্র-সমালোচক রজার এবার্ট লিখেছিলেন:

Director Allen Smithee, a name I’m not familiar with, allows his story to unfold naturally. He never preaches, and he never lingers on the obvious.

নিউ ইয়র্ক টাইমসও ঘোল খেয়ে গেল। পত্রিকাটির হাওয়ার্ড থমসন লিখলেন:

The mounting tension is well-spun. Using the color and camera graphically, Mr. Smithee has an adroit facility for scanning faces and extracting background detail.

অ্যালান স্মিদি নামটি গ্রহণ করার পেছনে একটা দারুণ যুক্তি আছে কিন্তু। অনেকে মনে করেন Alan Smithee আদতে the alias man-এর অ্যানাগ্রাম। ব্যাপারটাকে বোধহয় পুরোপুরি কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ডিরেক্টেড বাই অ্যালান স্মিদি

প্রায় তিন দশক হলিউডে বেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অ্যালান স্মিদি। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান হিস্ট্রি এক্স সিনেমা তৈরির সময় পরিচালক টনি কেই চেয়েছিলেন অ্যালান স্মিদিকে ব্যবহার করতে। কারণ তার মনে হয়েছিল অভিনেতা এডওয়ার্ড নর্টন আর স্টুডিও উভয়ই সিনেমাটি প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনধিকার চর্চা করছে। এ নিয়ে পত্রিকায় তিনি নর্টনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন, নিজের নাম প্রতিস্থাপনের জন্য প্রচুর লবিয়িংও করেছিলেন। এতে করে পুরো ব্যাপারটি এত ওপেন সিক্রেট হয়ে যায় যে তাতে করে আর স্মিদি'র নাম ব্যবহার করলেও কোনো লাভ হতো না। কারণ সিনেমার মূল পরিচালকের কথা লোকে ততদিনে জেনে গিয়েছে। আর এ যুক্তিতেই টনি'র আবেদন নাকচ করে দেয় ডিজিএ।

অ্যালান স্মিদি'র প্রয়াণ

অ্যালান স্মিদিকে পর্দায় নিয়ে আসার ভুলের ফলেই তার 'মৃত্যু' হয়। ১৯৯৮ সালে জো এশ্টেরহাসের লেখা ও প্রযোজনায় তৈরি করা হয় অ্যান অ্যালান স্মিদি ফিল্ম: বার্ন হলিউড বার্ন। এ সিনেমায় একজন পরিচালককে দেখানো হয় যিনি ট্রায়ো নামের একটি ফিল্ম বানাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, এ পরিচালক ভদ্রলোকের নাম অ্যালান স্মিদি (চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন এরিক আইডল)। তো আমাদের সিনেমার অ্যালান স্মিদিও ঠিক করেন তিনি পরিচালকের স্থান থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করবেন কারণ স্টুডিও তার ছবি কেটে ফেলছে তাদের সুবিধামতো। কিন্তু সমস্যা হলো তার নিজের নামই অ্যালান স্মিদি, সুতরাং তার পক্ষে ছদ্মনাম হিসেবে অ্যালান স্মিদি নামটি আর ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এ প্যারাডক্সের পরে কী হলো সেটা জানতে হলে আপনাকে সিনেমাটা দেখতে হবে কিন্তু বাস্তবে যা ঘটলো তা আরও বেশি ইন্টারেস্টিং।

বাস্তবের সিনেমাটির পরিচালক (মানে বার্ন হলিউড বার্ন) আর্থার হিলার দাবি করলেন এশ্টেরহাস তার কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তাই তিনি পরিচালক হিসেবে নিজের নাম প্রত্যাহার করে অ্যালান স্মিদিকে স্থলাভিষিক্ত করেন। অর্থাৎ অ্যালান স্মিদিকে নিয়ে বানানো ফিল্মে পরিচালকও অ্যালান স্মিদি!

এ সিনেমায় ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স ছিল সিলভেস্টার স্ট্যালন, জ্যাকি চ্যান, হুপি গোল্ডবার্গদের মতো তারকাদের। কিন্তু যতই ইন্টারেস্টিং ব্যাপারস্যাপার ঘটুক না কেন, বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লো ফিল্মটি। ১০ মিলিয়ন ডলারের সিনেমাটি আয় করে মাত্র ৪৬০০০ ডলার। এর সাথে সাথে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এটি জেতে বেশ কয়েকটি গোল্ডেন রাপ্সবেরি পুরস্কার। এসব ঘটনার কারণে গণমাধ্যমে সিনেমাটি নিয়ে বেশ জোরেসোরে সংবাদ প্রচারিত হয়। এতসব নেতিবাচক রিভিউ আর সংবাদের দরুন ডিজিএ বাধ্য হয় অ্যালান স্মিদি নামটিকে অবসরে পাঠিয়ে দিতে। কারণ ততদিনে সবাই অ্যালান স্মিদিকে চিনে ফেলেছে, তার আর গোপন থাকার উপায় রইলো না। এরপর থেকে অফিসিয়ালি অ্যালান স্মিদি নামটি আর ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য তার বদলে অন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে প্রচুর। যেমন ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারনোভা চলচ্চিত্রের জন্য পরিচালক ওয়াল্টার হিল-এর বদলে 'থমাস লি'-কে ব্যবহার করা হয়।

তথ্যসূত্র
Fandom

Los Angeles Magazine

Mental Floss

How Stuff Works





No comments

Theme images by alacatr. Powered by Blogger.