গোপাল ভাঁড়ের গল্পলোকে: একটি ক্ষোভ
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় গোপালের রাজ্যে চলে যাই। ওখানে যেন কোনো দুঃখ নেই, বিষণ্ণতা নেই, কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অবকাশ নেই। আছে শুধু এক ক্লেদমুক্ত, নিতান্ত সরল, স্বল্পাকাঙ্ক্ষী জীবনের হাতছানি। এ রাজ্যের মানুষগুলোর মনে লোভ নেই, থাকলেও তার পরিমাণ এতটাই নগণ্য যে তা ক্ষমার্হ। তারা দিন আনে দিন খায়, তাদের রাজামন্ত্রীর মতো জীবনযাপনের শখ নেই। এস. এম. সুলতানকে নিয়ে তারেক মাসুদের তৈরি আদম সুরত দেখেছিলাম। সেখানে বাংলার কৃষকসমাজ প্রসঙ্গে সুলতান বলেছিলেন, এদের জীবনকে নিয়ে বেশি প্রত্যাশা নেই। এরা বেশি কিছু চায় না, স্রেফ দুটো মোটা চালের ভাত, আর আটপৌরে কাপড় হলেই তারা সন্তুষ্ট। আমাদের কৃষ্ণনগরের সাধারণ মানুষগুলোও মনের দিক থেকে এরকম অসাধারণ। জীবনচক্রের এই ঘূর্ণনের সাথে তারা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। তাই তাদের দৈনন্দিন জীবন এতটাই সহজ আর সাদাসিধে যে তা দেখলে মনের মধ্যে একরকম ঈর্ষার জন্ম হয় বৈকি। আমাদের এই জটিল সমাজব্যবস্থার সব কিণ্বস্রাবি মুহূর্তগুলো থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই বলেই হয়তো আমরা কার্টুনজগতের ওই মায়ায় জড়ানো দুনিয়ায় নিজেদেরকে ক্ষণকালের জন্য হারিয়ে ফেলতে চাই।
গোপাল ভাঁড়। ছবি সৌজন্য সনি আট |
গোপাল ভাঁড়ের সমস্তই নিখাদ প্রশংসার দাবীদার, শুধু একটা ব্যাপারে এসেই সবকিছু কেমন যেন অপ্রত্যাশিতরূপ ধারণ করে। গোপাল ভাঁড় আমাদের একঘেয়ে জীবনের বনেদী বিনোদনের বাইরে সরল বিনোদনের একটি দিব্য উপঢৌকন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কিন্তু যখনই দেখি গোপাল ভাঁড়-এ অন্যের গল্প মেরে দেওয়া হচ্ছে কোনো প্রকার কৃতজ্ঞতা স্বীকার ছাড়া, তখন একজন গোপাল ভক্ত হিসেবে, এবং একজন সচেতন মানুষ হিসেবে, এমনকি সাংবাদিকতার একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে গ্রহণ করতে কিছুটা কষ্টবোধ তৈরি হয় অবশ্যই। গোপাল ভাঁড়ের কিছু গল্প বহুল প্রচলিত, সেগুলো চিরায়ত সাহিত্যের অংশ হয়ে গেছে। এবং এটাও খুব স্পষ্ট যে, এই স্বল্পসংখ্যক মৌলিক গল্প নিয়ে আর যাই হোক, দীর্ঘ ১২০০০ মিনিটের (প্রতি পর্ব গড়ে কুড়ি মিনিট ধরে, ৬০০ পর্ব) সফল সিরিজ তৈরি সম্ভব নয়। সেজন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গোপাল ভাঁড়ের গল্পকে সমন্বয় করা হয়েছে এবং এতে কোনো অসুবিধে নেই। এমন সব চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে যেগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। শক্তিশালী অ্যান্টাগনিস্ট, চমৎকার প্লট, চোখে সুখ দেওয়া সেটিং- সবই আছে এখানে। তাই এই চমৎকারিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য গোপালের হাতে উড়ন্ত-খাট তুলে দেওয়াতেও কোনো ক্ষোভ নেই। রাজবিজ্ঞানীকে শঙ্কুর মতো মহা-উদ্ভাবকের ছায়ায় নির্মাণ করা হলেও তা-তে খেদ নেই।
কিন্তু তা-ই বলে বাংলার চিরায়ত লোকসাহিত্যের সুমধুর গল্পগুলোকেও গোপালের নামে চালিয়ে দেওয়া উচিত কি? জসিম উদ্দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প-কে গোপাল ভাঁড়ের নামে প্রচার করা কতটা গ্রহণযোগ্য? এই গল্পগুলো গোপালের সাথে বেশ মানিয়ে যায়। কিন্তু তার সাথে সাথে একপ্রকার বাস্টার্ডাইজেশনেরও সূচনা ঘটে যা আমরা অনেক সময় খেয়াল করে উঠি না। সাহিত্যের মর্যাদা রক্ষায় হলেও এ কাজটা করা উচিত নয়। অবশ্য নির্মাতারা যদি মূল গল্পের লেখকের ক্রেডিট দিয়ে থাকেন, তাহলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়। এ কাজটুকু তো করাই যায়। তা-তে সাপও মরলো, লাঠিও না ভাঙল।
No comments