Header Ads

Header ADS

প্রাণনাথের সমভিব্যহারে এক প্রহর

প্রাণনাথের সহিত পথিমধ্যে সাক্ষাৎ। উহাকে চিনি না। গৃহ প্রত্যাবর্তনের গাড়িতে সে আমার পাশে বসিয়াছিল। ক্ষণিকের সহযাত্রী। হস্তে একখানা নব্যযুগীয় থলিয়া, নীল রঙের পূর্ণবাহু শার্ট, কালো পাতলুন আর পদযুগলে জুতো। দখিন হস্তের কবজিতে রক্তবর্ণ ধাগা সনাতনধর্মের প্রতি তাহার আজন্ম আনুগত্যের নিদর্শন প্রকটভাবে প্রকাশ করিতেছিল। মুখাবয়ব আচ্ছাদিত থাকায় উহার চেহারা দেখিতে পাইনি। কিন্তু কণ্ঠ তাহার শোনা হইয়াছিল সারা পথটুকুজুড়েই।  কারণ, বাসগাড়িতে অবরোহণের পর হইতেই তো সে আলাপ জুড়িয়া দিয়াছিল। প্রথমে বাসভাড়া যে কতটা তাহার আয়ত্তের মধ্যে সে কথাটা বারংবার উৎফুল্লচিত্তে ঘোষণা করিল। 'আসলে, ভাই, লোকাল গাড়ির কথা চিন্তা করলে, ভাড়া কিন্তু অনেক কম। কী বলেন?' আমার নিকট হইতে প্রত্যাশিত ইতিবাচক মৃদু মস্তক আলোড়ন দেখিয়া তাহার উৎসাহ আরও বাড়িয়া গেল। 'মাত্র দশ টাকাতেই বাড়ি পৌঁছানো যায়, বেশ ভালো।' তাহার কথাগুলি আগাগোড়া প্রমিত নয়, কিন্তু অনুধাবন করা যায় প্রাণনাথ শিক্ষাদীক্ষার সংস্পর্শ লাভ করিয়াছে।

Life of Prannath

আমাদের শকট ততক্ষণে রাস্তায় গড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে। আমায় জিজ্ঞাসা করিল, সেই চিরায়ত প্রশ্ন, মহাশয়ের কী করা হয়। নিতান্ত অনুৎসাহী কণ্ঠে আপন শিক্ষালয়ের কথা উল্লেখ করিলাম। নিখাদ প্রশংসাভরা কণ্ঠে বাহবা জানাইয়া পরক্ষণেই নিজের শিক্ষায়াসের কথা ভাবিয়া একটু আফসোস করিল সে।

সচরাচর আর আট-দশ জনের মতো শিক্ষালাভের চেষ্টায় প্রাণনাথ বিশেষ সুবিধা করিতে পারেনাই। কন্যাভারাগ্রস্ত পরিবারকে 'কন্যাদায়মোচনের' নিমিত্তে ভিটেটুকু রাখিয়া আর সব ভূসম্পত্তির মায়া ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। শহরের ফার্মেসিতে কর্ম করিয়া, দিনান্তের অবসরে পাঠাভ্যাস করিয়া সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরের দ্বার অবধি পোঁছাইয়াছিল প্রাণ। স্বোপার্জিত শিক্ষা তাহার। তাহার জীবনসংগ্রামের আলেখ্য শ্রবণ করিয়া জীবনের নিতান্তই কোনোরূপ অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া না পড়িয়া অনায়াসে এই পথটুকু পাড়ি দিয়া আসিবার কথা স্মরণ করিয়া প্রাণনাথের পাশে উপবেশনরত আমার কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ হইলো বটে। তথাপি, আমাদিগের মধ্যে এইরূপ বৈপরীত্য ও বিচিত্রিতার নিমিত্ত কর্মকে দূষিব, না নিয়তির গত্যন্তর নাই ভাবিয়া আপন অনুশোচনাবোধকে প্রবোধ দান করিব তাহা ঠিক স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

প্রাণনাথ এক্ষণে ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে দিনাতিপাত করিতেছে। তাহার কর্মক্ষেত্র ও গৃহের পথ একই অঞ্চলে বলিয়া মাঝে মাঝে সে কাজ ফাঁকি দিয়া গৃহে গমন করে আহারের উদ্দ্যেশে। আজও তাহাই করিতেছে, কহিল, শুধু খাইবে না, কিছুক্ষণ দিবানিদ্রাসুখ অনুভব করিয়া লইবে। আমি যাহাকে ফাঁকি ভাবিয়া লইলাম, তাহা তাহার কাছে ফাঁকি নয় বরং বুদ্ধিমানের কাজ বলিয়া বিবেচিত হইতেছে। তাহার কাজের আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া বিষয়টি সম্পর্কে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিল। তাহাদের কাজ নাকি নিশুতিরাতে, যখন দোকানিগণ ক্রেতা বিদায় করিয়া দোকান বন্ধ করিবার তালে থাকে। সেই অলস সময়টুকুতে দোকানদারকে নিজের পণ্য গছাইয়া দিয়া আসে প্রাণনাথ। মাঝেমধ্যে তাহাকে নিজের গাঁটের কড়ি ব্যয় করিয়া দোকানিকে উপঢৌকন প্রদান করিতে হয়। দোকানিকে উৎফুল্ল না রাখিলে ব্যবসা চলিবে কী করিয়া! মাসমাহিনা যাহা আসে তাহাতে সংসার চালানো দায়, ওই কমিশন হইতে যা একটু উপরি আয়, তাহাতে অবশ্য প্রাণনাথকে সন্তুষ্ট বলিয়াই বোধ হইল।

চাকুরির জন্য যথেষ্ট চেষ্টাচরিত্র করিয়াছিল সে। কিন্তু নীতিহীন সমাজে অর্থ ছাড়া কর্মযোগ প্রায় শুন্য। কোনো একটি পরীক্ষায় সব ধাপ অতিক্রম করিয়াও শুধু মোটা পয়সার অভাবে কাজে ঢুকিতে পারে নাই প্রাণ। ওই রাজকর্মচারী নাকি তাহার নিকট কিঞ্চিৎ জলখাবারের অনুযোগ করিয়াছিল। শুনিয়া প্রাণনাথের মাথায় রাগ চড়িয়া যায়। রাজকর্মচারীটিকে মাতার সহিত তাহার সম্পর্ক বিষয়ে শ্রীযুক্ত ফ্রয়েদ মহাশায়ের তত্ত্বকথার ইঙ্গিত করিয়া ভীষণ ভরতসনার কথা শুনাইয়া দিয়াছিল প্রাণনাথ।

‘ফাইজলামি করস? মারিহালামু। ইয়ান ফেনী শহর। তোর চাকরি আঁই কইত্তান্ন।’

তারপর হইতে আর চাকুরীর অনুসন্ধানে তাহার প্রবৃত্তি হয় নাই।

প্রাণনাথের কথা থামিতেছেই না। আমি মাঝেমধ্যে সায় দিতেছি, মুখ দিয়া খানিক হু-হা করিতেছি। শেষ ইশটিশন হইতে জনৈক হকার উঠিয়াছে। যাত্রীদীগের নিকট তাহার উৎসর্গ পেঁপের বীজ। এ বীজ নাকি শ্যামদেশ হইতে আনীত হইয়া এক্ষণে বঙ্গদেশের মাটিতে সমর্পিত হওয়ার অপেক্ষায় রহিয়াছে। হকার মহাশয়ের বাক্যস্রোতে অনেকে যাত্রীই তাহাদের বিচারবুদ্ধির কূল হারাইয়াছেন। তাহারা সোৎসাহে কুড়ি পয়সা ব্যয় করিয়া দশখানা করিয়া শ্যামদেশের হৃষ্টপুষ্ট পেঁপের বীজ কিনিয়া লইলেন। আমাদের প্রাণনাথ অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। অথচ নতুন এই ব্যবসায়ীর কথায় সেও প্রলুব্ধ হইয়া এক পুঁটুলি বীজ কিনিয়া লইল। ‘দেখি কী হয়, না হলেও আফসোস নাই’, কহিল সে। মুখাচ্ছাদনের নিচে তাহার মুখশ্রী যে হাসিতে উদ্ভাসিতে হইয়াছে তাহা টের পাওয়া গেল।

আমিও মনে মনে খানিক হাসিলাম। কল্পনা করিলাম তাহার গৃহপ্রাঙ্গণের পেঁপে গাছটি পেঁপের ভারে নুইয়া পড়িয়াছে। তাহার মা প্রত্যহ প্রত্যুষে গাছের নিচে জলসিঞ্চন করেন। পেঁপের স্বাদ আর রঙের কল্পনা না করিয়া তাহা ভবিষ্যতে প্রাণনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ছাড়িয়া দিলাম।

গাড়ি আসিয়া তাহার ইশটিশনে থামিল। প্রাণনাথ অবরোহনের উদ্যোগ করিল। গাত্রোত্থান করিয়া আমার দিকে হাতখান বাড়াইয়া দিল। ‘ভালো লাগল, দাদা। কিছু মনে করবেন না, কাজের সুবাদে বেশি কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। ভালো থাকবেন। প্রণিপাত।’ সে নামিয়া গেল। আমি ভাবিলাম, মনে করার কোনো কারণ নাই, বরঞ্চ আমি দুঃখ পাইতেছি এই ভাবিয়া যে কথা কহা শিখিবার নিমিত্তে তিন বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াও কিছুই শিখিতে পারিলাম না। আর তুমি কি অনায়সেই না কথা বলিতে পারো। এ অতি চমৎকার গুণ, তাহা যদি তুমি বুঝিতে। মনে হইল, নিয়তি তাহাদিগকেই সহায়তা করে যাহারা প্রাপ্তির যোগ্য। প্রাণনাথ, তুমি এই চমৎকার বরটুকু পাইয়াছ, আমি পাইনি। তুমি আরও পাও, এই কামনাই করি। তোমার জীবন আরও সুখের হউক।


No comments

Theme images by alacatr. Powered by Blogger.